গল্প করতে করতে রঙিন দুনিয়ায় ভেসে যেতে সাহায্য করুন আপনার একান্ত প্রিয় মানুষটিকে। যদি গান, বাজনা, আঁকার মতো তেমন কোনো হবি না থাকে, নতুন করে শিখতেও তো কোনো অসুবিধা নেই। শেখার কোনো বয়স হয় না। বরং জানবেন, এই বয়সে শেখার আনন্দ আরও বেশি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা জিনিসও বাড়েÑ সময়। সকাল থেকে দৌড়ঝাঁপ, হাজারো কাজ, দায়দায়িত্ব তারই মাঝে আড্ডা, সামাজিকতা। সব মিলিয়ে একেবারে হন্তদন্ত জীবন যাকে বলে। কেবলই মনে হয়, কবে এই গোল্লাছুটের জীবন থেকে একটু ছুটি পাব? কিন্তু সত্যিই যখন সেই বহু কাক্সিক্ষত জীবনের সেই পর্যায়টি আসে, তখন কেমন যেন সব হিসাব গুলিয়ে যায়। হাতে অখ- অবসর, এটাই চরম অস্বস্তিতে ফেলে দেয় বর্ষীয়ান মানুষটিকে। কিন্তু সেই অস্বস্তিকে পাত্তা দিলে চলবে না।
অবসরের অখ- সময়কে কাজে লাগিয়ে ভালো থাকার নানা উপায় আছে। সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। পরিবারের লোকেদেরও এই ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। বহু মানুষেরই মূল কাজের বাইরে আরও নানা বিষয়ে উৎসাহ থাকে, বিভিন্ন বিষয়ে চর্চার অভ্যাস থাকে, যা হয়তো কাজের চাপে, উদ্যমের অভাবে তেমনভাবে আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ প্রিয় বিষয়ের প্রতি সেই ভালোলাগা তো থেকেই গেছে। সেই ভালোলাগাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব কিন্তু পরিবারের প্রিয়জনদের। গান-বাজনা, ছবি আঁকা সে যা-ই হোক না কেন, তার চর্চার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে শিক্ষক রাখুন, তাহলে নিয়মিত চর্চার ইচ্ছা জাগবে। এ তো শুধুই নিজের জন্য শেখা, ভালোবেসে ভালোলাগার বিষয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রয়াস। ছবি আঁকার শখ থাকলে, গ্লাস পেইন্ট করার ইচ্ছা থাকলে সব সরঞ্জাম এনে দিন। সঙ্গে বসুন।
গল্প করতে করতে রঙিন দুনিয়ায় ভেসে যেতে সাহায্য করুন আপনার একান্ত প্রিয় মানুষটিকে। যদি গান-বাজনা, আঁকার মতো তেমন কোনো হবি না থাকে, নতুন করে শিখতেও তো কোনো অসুবিধা নেই। শেখার কোনো বয়স হয় না। বরং জানবেন, এই বয়সে শেখার আনন্দ আরও বেশি। কোনো পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপার নেই, প্রমাণ করার তাগিদ নেই, আত্মীয়পরিজন বাড়িতে আসামাত্র বড়দের অনুরোধে, একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কী শিখেছেন তা প্রদর্শনের চাপ নেই! এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একাকিত্ব আসবেই। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সেই একাকিত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে জবরদস্ত উপায়ে। মাথা নত করা চলবে না, তাহলেই সে পেয়ে বসবে। আর তার জন্য প্রয়োজন নিজের চেষ্টা ও পরিবারের সহায়তা। যত দিন পারবেন, সচল থাকার চেষ্টা করুন। নিয়মিত এক্সারসাইজ, হাঁটা, স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া, সময়মতো যথাযথ বিশ্রাম তো প্রয়োজন বটেই, সেই সঙ্গে দরকার ব্যস্ত সামাজিক জীবন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন নিয়ে জমিয়ে বাঁচুন, বেড়াতে যান আর শখের কাজে মন দিন। দেখবেন বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জীবন দিব্যি তরতরিয়ে এগোচ্ছে।
স্বপ্ন কুমার মজুমদারের সেই কবিতার কথা মনে পড়ে যায়, হয়তো আমার যাচ্ছে বয়স বেড়ে/ তাই বলে কি শখ দেব সব ছেড়ে?/ না হয় কিছু চুল পেকেছে, দূরেও নয় কেউ রেখেছে/ তাই বলে কি অমনি যাব হেরে!/ বাড়ছে বয়স! গেলই না হয় বেড়ে!’
বয়স নেহাত সংখ্যা বা বছরের হিসাবে আটকে নয়। তবে সময় দ্রুত যেতে পারে, আবার দীর্ঘায়িত মনে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কী করার আছে? আছে অনেক কিছুই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়া স্বভাব, স্মৃতিলোপ বা আলসেমির প্রভাব অনেকেই এড়াতে পারেন না। শরীরেও বিভিন্ন অসুখ বাসা বাঁধে। পরিবর্তন আসতে শুরু করে ত্বকে। মেজাজও ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বিষণœতার ভূত মাথা থেকে তাড়ানো যায় না। শরীরের অসংগতি লুকাতে নানা ধরনের ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস গড়েন অনেকে। তবে অত ভাবারও কিছু নেই। জীবনে এত ভাবার আসলে প্রয়োজন হয় না অনেক সময়। কারণ, সামাজিক নিন্দা পিছু লেগেই থাকবে।
সব সময় সামাজিক নিন্দাই যে আমাদের ব্যতিব্যস্ত রাখে, বিষয়টি এমনও নয়। অনেক সময় সামাজিক নানা মন্তব্যও আমাদের কষ্ট দেয়। বিশেষত নারীকে শারীরিক নানা বিষয়েও অনেক মন্তব্য সইতে হয়। অনেক সময় পদমর্যাদা বয়স পরিমাপের ডিসাইডিং ফ্যাক্টর হতে পারে। পুরুষদের অনেকেই মাথায় কলপ ব্যবহার করেন। কিন্তু নারী সামান্য হেয়ারস্টাইল করলে, চুল ভিন্নভাবে বাঁধলেই শুরু হয় সমালোচনা। নারীর পোশাক নিয়ে তর্ক তো বহু পুরোনো। সামাজিক নিন্দা বা সমালোচনা নারীদের অবদমনের একটি বড় বিষয়। কিন্তু সেদিকে আদৌ মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ কোথায়! সমন্বয় করে নারীকে চলতে হয়। তবে বয়সটা বাড়লে কিছুটা হলেও ইতিবাচকভাবে দেখা জরুরি সব।
দশ-বিশ বছর আগে দাই-নানি বয়সের নারীরা ডায়েট নামক শব্দ শুনেছেন কি না সন্দেহ আছে। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস গড়ে না উঠলে ডায়েট বা ব্যায়াম কাজে আসবে না। অধিকাংশ নারীই জিমে যান। অনেকে ক্র্যাশ ডায়েট করে কষ্ট করেন। সাময়িক লাভ হয়। আবার ওজন বাড়ে। স্ট্রিট ফুড, ফাস্ট ফুড, ¯œ্যাকস আইটেমের এখন অভাব নেই। সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই অনেকে বাড়িতে খাওয়া এড়ান। বাইরে গেলেই নানা উপলক্ষে স্ট্রিট কি ফাস্ট ফুড খেতে হয়। হেলদি লাইফস্টাইলের বিষয়টি মাথাতেই থাকে না। অথচ হেলদি লাইফস্টাইল যে খুব জটিল তা নয়। সকালে উঠে চিরতার রস, ইসবগুলের ভুসি বা যষ্টিমধু খাওয়া গেলে ভালো। দৈনিক আমলকী বা ফাইবারসমৃদ্ধ কিছু ফল খাওয়া যেতে পারে। হেলদি স্ট্রিটফুড যেমন ছোলা, ভুট্টা, পেঁপে, আনারস, পেয়ারা ইত্যাদি তো আছেই। আজকাল গ্যাসের সমস্যায় অনেকেই ভোগেন। তারা এই খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমেই তার নিরসন ঘটাতে পারেন। মেথি, কালিজিরা, সিনামেন একসঙ্গে বেটে বা গুঁড়া করে ডেইলি ১ চামচ খাওয়া যেতে পারে। চায়ে চিনি বাদ দিন। খাবারে আলাদা লবণ কমান। ভাতের পরিমাণ কমান। ডায়েটে যুক্ত করুন লাল আটার রুটি, ব্রাউন ব্রেড। তার মানে এই নয় যে পছন্দের খাবার একেবারেই নয়। তবে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
নারীদের বয়সফোবিয়া একটু বেশিই। সামাজিক নিন্দা, সাংস্কৃতিক গঠন-গড়নের ফলেই বয়স সম্পর্কে নারীদের একধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। অধিকাংশ নারীই তাদের বয়স কমিয়ে দেখতে পছন্দ করেন। এটি সাংস্কৃতিক নির্মাণ। কারণ, সমাজে তাদের বয়স সম্পর্কে রয়েছে নেতিবাচক মন্তব্য। চল্লিশের পর একজন নারী যদি কোনো দিন ঘুরতে যাওয়ার আবদার করেন, তাহলে দেখা গেল কেউ বলবে, ‘ঘোরার বয়স আছে আর?’ আবার একটু রঙিন জামা পরলেই বলবে, ‘খুকি সাজতে চাও?’ এসব মন্তব্যই বলে দেয় নারীর বয়স সম্পর্কে সমাজ রক্ষণশীল। তাই নারীকেও বয়সের ব্যাপারে রক্ষণশীল হতে হয়। পঞ্চাশে বা পরে ভালো থাকতে হলে সেটার প্র্যাকটিস শুরু করতে হবে আগে থেকেই। কাজের চাপে সংসারের ফাঁদে পড়ে খেলাধুলা বাদ দিলেও হাঁটা, জিম, যোগব্যায়াম আর সাঁতারটা চালু রাখুন সপ্তাহে মিনিমাম ৩ থেকে ৪ দিন। তার সঙ্গে ডায়েট। ত্বকের রুটিনচর্চা না করলে বয়স লুকানোর খেলাতেই মত্ত থাকতে হবে। ভুলবেন না আপনার সৌন্দর্য সুন্দর ত্বকে আর পজিটিভ মনে। পুরোনো দিনের মতোই ঘরোয়া টোটকাতে ফিরতে হবে। সেটা নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। আমাদের নারীদের শরীরে বিরাট একটা ধকল যায় সন্তানের জন্মের সময়। তাই রুটিন জীবনচর্চায় ফিরে যাওয়া জরুরি। সঙ্গে প্রয়োজন রূপচর্চায় রুটিন মনোযোগ। দিন শেষে বয়স একটা সংখ্যা। আর নারীর বয়সবিষয়ক ভাবনা সমাজের চাপানো।