রঙে রঙে মেহেদি

আগের দিনে মেহেদি পাতা বেটে হাতে দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। তবে এখন টিউব মেহেদির কল্যাণে তা অনেক সহজ হয়ে গেছে। টিউব মেহেদি দিয়ে আপনি খুব সহজেই মনের মতো করে ডিজাইন করতে পারেন। টিউবজাত মেহেদি সাধারণত তৈরি হয় কাঁচা মেহেদি পাতা ও বিভিন্ন হারবাল উপাদানের সংমিশ্রণে। তাই খুব সহজেই এ মেহেদিতে হাত রঙিন করা যায়।

উৎসবের সময় হাতজুড়ে মেহেদি না থাকলে আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। তবে উৎসবভেদে মেহেদির নকশার ধরন আলাদা হয়। যেকোনো ধর্মীয় উৎসবে মেহেদির নকশা হয় খুব ছিমছাম, গোছানো ও সূক্ষ্ম কারুকাজের। গোলাকার কিংবা একটি লতানো আলপনা। মেহেদি লাগানোর আগে সেটি ত্বকের জন্য উপযুক্ত কি না, এই বিষয়ে জেনে নেওয়াটাও জরুরি।

বাজারে দুই ধরনের মেহেদি পাওয়া যায়। একটি হলো তৈরি করা বা ইনস্ট্যান্ট মেহেদিতে ৫ থেকে ১০ মিনিটে রং আসে এবং প্রতি ধোয়াতে হাত থেকে রং কমতে থাকে। আরেকটি হলো প্রাকৃতিক বা অর্গানিক মেহেদি। দুই শিল্পীর মতে, ঈদ, বিয়েসহ যেকোনো উৎসবেই অর্গানিক মেহেদি ব্যবহার করা ত্বকের জন্য ভালো।

কারণ, এই মেহেদি যেহেতু হাতে তৈরি, তাই এতে রাসায়নিকের ব্যবহার থাকে না। এর রং গাঢ় হয় এবং ত্বকের জন্য ক্ষতিকর নয়। সম্পূর্ণ অর্গানিক মেহেদি পাতার পাউডার থেকে তৈরি এটি। অর্গানিক মেহেদিতে রং আসতে সময় লাগে ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা। এই রং স্থায়ী হয় বেশি দিন। মেহেদি পাতার রস ত্বকের কোষগুলোকেও সতেজ রাখে। ফলে চামড়া মরে উঠে যায় না। ৮ থেকে ১০ দিনের আগে অর্গানিক মেহেদির রং ফ্যাকাশে হয় না। রং উঠে যাওয়ার পর ত্বকের সজীবতা ধরে রাখে।

কিশোরী, তরুণীদের পাশাপাশি অনেক শিশুও মেহেদি দিয়ে থাকে। যাদের ত্বক সংবেদনশীল এবং অ্যালার্জির সমস্যা, তাদের জন্য অর্গানিক মেহেদি ব্যবহার করা ভালো। অন্যদিকে, ইনস্ট্যান্ট মেহেদিতে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। তাই এটা ব্যবহার না করা ভালো।

মেহেদি হাতে দেওয়ার আগে এই বিষয়গুলো দেখে নিন:

 কোন ধরনের নকশার মেহেদি দিতে চান, সে বিষয়ে ভালো ধারণা রাখুন। কোনো মেহেদি নকশাকার দিয়ে নকশা করাতে চাইলে নিজের পছন্দ সম্পর্কে তাকে স্পষ্ট ধারণা দিন।

 মেহেদি লাগানোর আগে হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিন। মলম, ক্রিম ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

 মেহেদি লাগানোর সময় টিস্যু পেপার, হালকা সুতি কাপড়, টুথপিক বা আলপিন সঙ্গে রাখুন।

 হাতে ওয়াক্স করার কমপক্ষে এক দিন পর মেহেদি লাগালো ভালো।

 মেহেদি দেওয়ার সময় খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন অতিরিক্ত নড়াচড়ার কারণে মেহেদির নকশা নষ্ট না হয়ে যায়। তাহলে হাত দেখতে বাজে লাগবে।

মেহেদি দেওয়ার পর শুকনো নকশার ওপরে লেবু, চিনির ঘন সিরাপ ব্যবহার করতে পারেন। এতে রং গাঢ় হয় এবং শুষ্কতা থেকে হাত রক্ষা পায়। এ ক্ষেত্রে লেবু, চিনির ঘন সিরাপটি তুলা দিয়ে আলতো করে নকশার ওপর চেপে চেপে দিন। খেয়াল রাখবেন যাতে পুরো নকশায় রসটি ভালোভাবে লাগে এবং নকশাটি উঠে না যায়।

মেহেদি তুলে ফেলার পর পরিচর্যা

হাত থেকে মেহেদি তুলে শুকনো হাতে শর্ষের তেল বা ভিক্স ব্যবহার করলে রং গাঢ় হয়। মেহেদি ওঠানোর পর অর্গানিক মেহেদির ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা হাতে পানি না লাগানোই ভালো। কারণ, পানির কারণে রং হালকা হয়। যারা ইনস্ট্যান্ট মেহেদি ব্যবহার করেন, লাগানোর আগে ভালোভাবে বুঝে নেবেন, ত্বকে ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা আছে কি না।

 ইনস্ট্যান্ট মেহেদি দেওয়ার পর অবশ্যই ভালোভাবে ঘষে হাত পরিষ্কার করতে হবে। খেয়াল রাখুন যেন রাসায়নিক মেহেদি হাতে না লেগে থাকে। যারা তাড়াতাড়ি রং উঠিয়ে ফেলতে চান, হাতের ওই অংশটুকুতে পেস্ট লাগিয়ে শুকানোর পর ঘষে তুলে ফেলবেন। সঙ্গে লেবু বা কাঁচা হলুদ দিয়েও ঘষে দেখতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে মাত্রাতিরিক্ত যেন না হয়ে যায়। এতে ত্বকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মেহেদির প্রচলন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের জায়গা থেকে শুরু হলেও পরে এই প্রথা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় পেয়েছে। মানুষ এখন এটাকে সর্বজনীন রূপে গ্রহণ করেছে। তবে একেক দেশে একেক ধরনের কারণ আর উদ্দেশ্যে মেহেদি ব্যবহার হয়।

ঈদে মেহেদি লাগানোর জন্য আপনি নানা ডিজাইন ব্যবহার করতে পারেন। কোনোটা সাদামাটা, আবার কোনোটা গাঢ় ডিজাইন। কেউ এক হাতে, আবার কেউবা হাত ভরে মেহেদি লাগাতে ভালোবাসেন। তবে যে যেভাবেই পড়েন না কেন, সেটাকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলেই আসল সৌন্দর্য। কেউ যান পারলারে, কেউ আবার ঘরে বসে নিজেই মেহেদিতে হাত রাঙিয়ে ফেলেন। মেহেদি পাতা বেটে হাত রাঙানোর দিন অনেক আগেই শেষ। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পাতা মেহেদির পরিবর্তে বাজারে নানা রকম টিউব মেহেদি এসেছে। এসব মেহেদির সঙ্গে নানা রকম ডিজাইন বইও পাওয়া যায়। আর মেহেদির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর নকশারও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এ ছাড়া অনলাইন, ইন্টারনেটে বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন পাওয়া যায়। তাই বৈচিত্র্যময় নকশায় হাত সাজানো আর কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।

মেহেদির ডিজাইনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ডিজাইনে মেহেদ পরে। তবে আরব দেশগুলোর মেহেদির স্টাইলগুলোই বেশি চলনসই। তাই আপনি মেহেদি লাগানোর সময় সেই ডিজাইনগুলো ফলো করতে পারেন। তবে আজকাল যে সবাই শুধু হাতে মেহেদি পরছে তা নয়, অনেকে পায়েও নজরকাড়া ডিজাইনে মেহেদি পরে।

নকশার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। ছোট ছোট ডিজাইন করে নকশা করা যায়, কোনাকুনিভাবে নকশা করা যায়, হাতের এক কোনা থেকে শুরু করে আঙুল পর্যন্ত ফুল দিয়ে ডিজাইন করা হয়। তবে হালকা নকশা সব রকম পোশাকের সঙ্গে খুব ভালো মানায়। ছোটদের জন্য হালকা নকশা খুবই বেমানান। তাদের দুই হাত ভরে মেহেদি পরিয়ে ভালো লাগে আর তারাও অনেক খুশি হয়। হাত ভরে মেহেদি নকশা আবার তিন রকমের হয়ে থাকে। যেমন: ময়ূর, কলকা, ফুলের নকশা। হাতের পাশাপাশি অনেকে পায়েও মেহেদি লাগায়। লতা, ফুল ও বিভিন্ন ডিজাইন করে পা ও মেহেদি রঙে রাঙানো হয়ে থাকে।

জেনে নিন মেহেদি নকল কি না তা চেনার উপায়

খাঁটি মেহেদির রং কখনো কালো হয় না। সব ধরনের কালো মেহেদিতেই ভেজাল বা কেমিক্যাল মেশানো থাকে। আসল মেহেদি কখনোই ৫ মিনিট বা তার কম সময়ে গাঢ় রং দেয় না। ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর আসল মেহেদির রং গাঢ় হতে থাকে।

মেহেদির রং গাঢ় খয়েরি না হলে অনেকেরই মন খারাপ হয়ে যায়। তবে জানেন কি? আসল মেহেদির রং কখনোই এতটা গাঢ় হয় না।

সতর্কতা

যাদের মেহেদিতে অ্যালার্জি থাকে, মেহেদি ব্যবহারের আগে তাদের সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের হাতে মেহেদি দেওয়ার সময় বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিভিন্ন ত্বকের সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে ভালো মানের টিউব মেহেদি বাছাই করতে হবে।

মেহেদির কেনার সময় মেয়াদ দেখে কিনুন। বেশি পুরোনো হলে আবার রং না হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

পারলারে মেহেদি লাগাতে গেলে দেখে নিন নতুন মেহেদি দিচ্ছে কি না। প্রয়োজনে নিজেই মেহেদি কিনে নিয়ে যান।

ফ্রিজে রাখা মেহেদি ব্যবহারের আগে কিছুক্ষণ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিন। তারপর হাতে লাগান।

শিশুদের হাতে দেওয়ার জন্য পাতা মেহেদি বেটে হাতে লাগাতে হবে। এতে শিশুর কোমল হাত সুরক্ষিত থাকবে।

মিনিটেই গাঢ় লাল রং পেতে এখন অনেকেই বিভিন্ন মেহেদি ব্যবহার করে থাকেন। এগুলো ত্বক এমনকি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। এগুলোতে প্রচুর কেমিক্যাল থাকে।

মেহেদি দেওয়ার পর অনেকে হাত ভিজিয়ে মেহেদি তুলে ফেলেন। আবার অনেকে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলেন। এটা একদমই ঠিক নয়। কারণ, সাবান ক্ষারীয় উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে। এটি মেহেদির রঙের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হাত ফিকে করে তোলে।

মেহেদি শুকানোর জন্য কখনোই হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করবেন না। এতে আপনার ডিজাইন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রাকৃতিকভাবে মেহেদি শুকাতে দিন। প্রয়োজন হলে ফ্যান ব্যবহার করতে পারেন মেহেদি শুকানোর জন্য।

চিনি ও লেবুর রস মেহেদির রং বেশি লাল করতে সাহায্য করে। কিন্তু এগুলোর ব্যবহার যদি বেশি হয়ে যায়, তবে মেহেদির রং গাঢ় খয়েরি কালার হয়ে যায়, তা দেখতে ভালো লাগে না।

মেহেদি হাতে পরার আগে খুব বেশি পানিজাতীয় খাবার খেতে হয় না।

হালকা আলোতে মেহেদি পরলে ডিজাইন ভালো হবে না। ভালো ডিজাইন তোলার জন্য পর্যাপ্ত আলোতে বসে মেহেদি লাগাতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top